একুশে পদকপ্রাপ্ত খ্যাতিমান কবি বেলাল চৌধুরী আর নেই। মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে রাজধানীর ধানমণ্ডির আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনি, ডায়বেটিসসহ নানা রোগে ভুগছিলেন। কবি বেলাল চৌধুরীর বড় ছেলে আবদুল্লাহ প্রতীক চৌধুরী গণমাধ্যমকে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।এক মেয়ে সাফিয়া আক্তার চৌধুরী মৌরী এবং দুই ছেলে আব্দুল্লাহ প্রতীক ইউসুফ চৌধুরী ও আব্দুল্লাহ নাসিফ চৌধুরী পাবলোকে রেখে গেছেন বেলাল চৌধুরী।
আবদুল্লাহ জানান, কিডনি জটিলতা, রক্তশূন্যতা ও থাইরয়েডের সমস্যা নিয়ে গত চার মাস ধরে ওই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৮০ বছর বয়সী বেলাল চৌধুরী। গত বৃহস্পতিবার রাতে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেয়া হয়। শুক্রবার অবস্থার আরও অবনতি ঘটায় বেলা সাড়ে ১২টার দিকে তাকে নেয়া হয় লাইফসাপোর্টে। লাইফসাপোর্টেই মারা যান তিনি।
একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সাংবাদিক বেলাল চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৮ সালে ১২ নভেম্বর, ফেনীতে। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ছাত্র অবস্থায় বেলাল জড়িয়ে পড়েন বাম ধারার রাজনীতিতে, ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাগারেও যান। ষাট ও সত্তরের দশকে কয়েক বছর কলকাতায় বসবাসের সময় সাহিত্য পত্রিকা কৃত্তিবাস সম্পাদনায় যুক্ত হন কবি। পরে পল্লীবার্তা, সচিত্র সন্ধানী ও ভারত বিচিত্রা পত্রিকার সম্পাদনায় যুক্ত হন।
কবিতা, গদ্য, অনুবাদ, সম্পাদনা, শিশুসাহিত্য মিলিয়ে বেলাল চৌধুরীল গ্রন্থ সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। ‘বল্লাল সেন’, ‘ময়ূর বাহন’, ‘সবু্ক্তগীন’ ছদ্মনামেও তিনি লিখেছেন। তার কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘নিষাদ প্রদেশে’, ‘আত্মপ্রতিকৃতি’, ‘স্থির জীবন ও নিসর্গ’, ‘জলবিষুবের পূর্ণিমা’, ‘সেলাই করা ছায়া’, ‘কবিতার কমলবনে’, ‘বত্রিশ নম্বর’, ‘যে ধ্বনি চৈত্রে শিমুলে’, ‘বিদায়ী চুমুক’ উল্লখযোগ্য। এছাড়া তার কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ ও গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল’, ‘ডুমুরপাতার আবরণ’, ‘চেতনার রঙ চন্দ্রশিলা’ এবং ‘লাকসাম দাদা ও অন্যান্য গল্প’।
‘কাগজে কলমে’, ‘মিশ্রচিত্রপট’, ‘নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়’, ‘জীবনের আশ্চর্য ফাল্গুন’, ‘নবরাগে নব আনন্দে’, ‘সুন্দরবন, সোঁদরবন ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘মুহূর্তভাষ্য’ ইত্যাদি তার গদ্যনির্ভর গ্রন্থ। শিশু-কিশোরদের জন্য বেলাল চৌধুরী লিখে গেছেন, ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’, ‘সপ্তরত্নের কাণ্ডকারখানা’, ‘সবুজ ভাষার ছড়া’।
নিজে লেখার পাশাপাশি হোর্হে লুই বোর্হেস, পাবালো নেরুদা, ডিলান টমাস, অক্তাবিও পাসের মতো কবিদের লেখা তর্জমা করেছেন বেলাল চৌধুরী; সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছু স্মারকগ্রন্থ। তার সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘জলের মধ্যে চাঁদ ও অন্যান্য জাপানি গল্প’, ‘বিশ্বনাগরিক গ্যেটে’, ‘পাবলো নেরুদা-শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি’, ‘শামসুর রাহমান সংবর্ধনাগ্রন্থ’, ‘পদাবলী কবিতা সংকলন’ ও ‘কবিতায় বঙ্গবন্ধু’।
বেলাল চৌধুরী কলকাতা থেকে ১৯৭৪ সালে দেশে ফিরে আসেন, যোগ দেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। সে সময়ে জাতীয় কবিতা পরিষদ ও পদাবলী কবিতা সংগঠন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৪ সালে একুশে পদক পান কবি বেলাল চৌধুরী। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, নীহাররঞ্জন স্বর্ণপদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা।