পরিবেশ বাঁচাতে চায় টেকসই ও প্রকৃতিবান্ধব ফ্যাশন

অন্যান্য মতামত

জামির হোসেন: পোশাক মানুষের সবচেয়ে দরকারি জিনিসগুলোর একটি। এটা ছাড়া একপাও চলার উপায় নেই। প্রয়োজন পূরণে তাই সবাইকেই পোশাক কিনতে হয়। কিন্তু বর্তমানে প্রয়োজন ছাড়াও বহু মানুষকেই নতনু নতুন পোশাক কিনতে দেখা যায়। বেশিরভাগ সময়ই তারা এগুলো কেনে খুব ঘনঘন এবং সস্তায়। কয়েকবার পরার পরেই তা ফেলে দেয়।

কেউ কেউ পরার জন্য নয়, শুধুমাত্র ওয়্যারড্রোবে বৈচিত্র আনার জন্য গাদাগাদা কাপড় কিনে থাকে। নিত্য-নতুন ফ্যাশনের কারণে এমন অভ্যাস। ফলে চাহিদা পূরণে গড়ে উঠেছে বিশাল ফ্যাশনশিল্প। কিন্তু মানুষের এই অতিরিক্ত ফ্যাশনের ধকলে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। পোশাক ও ফ্যাশনশিল্প গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে ভয়াবহ মাত্রায়। দূষিত করছে বায়ু, পানি, মাটি ও প্রাণ-প্রকৃতি। সৃষ্টি করছে মাত্রাতিরিক্ত বর্জ্য। যা শেষে জলবায়ু ও পরিবেশের ‘বারটা’ বাজাচ্ছে। তাই জলবায়ু ও পরিবেশ বাঁচাতে চায় টেকসই ও প্রকৃতিবান্ধব ফ্যাশনশিল্প।

বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭৫৩ কোটি। বিরাট এই জনসংখ্যার পোশাক চাহিদাও গগনচুম্বী। গত বছরের এক রিপোর্ট মতে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ৩ লাখ কোটি মার্কিন ডলারের ফ্যাশন বাণিজ্য রয়েছে। এটা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দূষণকারী খাত। একইসঙ্গে এটি সারা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পানি ব্যবহারকারীও বটে। জলবায়ু ও পরিবেশ দূষণে জাহাজশিল্প ও বিমান যোগাযোগের প্রভাব এখন সবারই জানা।

কিন্তু এই দুই খাতের সমন্বিত দূষণের চেয়েও বেশি দূষণ ঘটছে পোশাকশিল্প থেকে। এই একটি খাত থেকেই বিশ্বের ২০ শতাংশ বর্জ্য পানি এবং ১০ শতাংশ কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ হচ্ছে। শিল্প-কারখানায় সুতা তৈরি থেকে শুরু করে কাপড় কাটা, সেলাই, ধোয়া ও শুকানো পর্যন্ত পরিবেশের প্রধান তিন উপাদান বায়ু, পানি ও মাটির ভয়াবহ দূষণ ঘটাচেছ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দূষণ সৃষ্টি করছে ডেনিম বা জিন্সের পোশাক।

জাতিসংঘের এক হিসাবে, একজোড়া জিন্সের প্যান্ট তৈরি এক কেজি তুলা লাগে। আর তুলা যেহেতু শুষ্ক আবহাওয়ায় উৎপন্ন হয়, তাই এক কেজি তুলা উৎপাদনে ৭ হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার লিটার পানির দরকার হয়। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের ১০ বছরে এই পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়। এর মানে একটা জিন্স তৈরিতে নষ্ট হয় একজন মানুষের ১০ বছরের খাবার পানি। এছাড়া ৬৯ মাইল গাড়ি চালানোর পর যে পরিমাণ কার্বন নির্গত হয় একই পরিমাণ কার্বন বের হয় একজোড়া জিন্স উৎপাদনে।

আর প্যান্টে রঙ করার জন্য যে কেমিক্যাল ডাই ব্যবহার করা হয়, তা খুবই ক্ষতিকর। ডেনিমে সবচেয়ে বেশি ব্যবহƒত হয় কেমিক্যাল ইন্ডিগো। এগুলো বিভিন্ন রকমের ক্ষতিকর রাসায়নিক তেল এবং ইঁদুরের বিষ থেকে তৈরি। ডেনিমে কেমিক্যাল শুধু রঙের জন্য নয়, কাপড় নরম করার কাজেও লাগে। এটি যেখানে উৎপাদন করা হয়, বিশেষ করে ধোয়া হয়, তার আশপাশের জমির উর্বরতা কমে যায়। পাশাপাশি এর তরল বর্জ্য জলাশয় ও পানির অন্যান্য উৎসকে দূষিত করে।

তবে কয়েক বছর ধরে পরিবেশ রক্ষায় সাসটেইনেবল ফ্যাশনের চর্চা শুরু হয়েছে। আর সেই সুবাতাসে ভেসে ফ্যাশন বিশ্বে এসেছে ‘জিরো ওয়েস্ট ডেনিম’। এটি হলো ডেনিমের একধরনের সাসটেইনেবল কালেকশন, যা তৈরিতে খুব কম পানি ও কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। পশ্চিমের অনেক বিখ্যাত ব্র্যান্ড এখন এ ধরনের পোশাক বাজারে এনেছে। উদ্দেশ্য একটাই—কীভাবে পরিবেশের ক্ষতি না করে ডেনিম তৈরি করা যায়। এ জন্য একেক কোম্পানি একেক পদ্ধতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। বাদ যাচ্ছে না লেজার টেকনোলজি, পিছিয়ে নেই রিসাইকেল পদ্ধতি। সব মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব ডেনিম।

সম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের পরিবেশগত অডিট কমিটি দেশটির সরকারের কাছে এই শিল্প বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। পরিবেশ এবং শ্রম বিষয়ক ১৮টি সুপারিশ করেছে তারা। ক্ষতিকর এমন শপিং করার অভ্যাস কমিয়ে আনতে কি করা যায় সে বিষয়ে টেকসই ফ্যাশন বিশেষজ্ঞরা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন।

১. কম কেনা বেশি কেনা
পরিবেশবাদী আন্দোলনকারীরা বলছেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, কম কিনতে হবে। নির্দিষ্ট কোন অনুষ্ঠান যেমন রাতে পরার কিংবা ছুটির দিনে পরার আলাদা আলাদা পোশাক কেনার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের। প্রথম দিকে মানুষ একে আক্রমণাত্মক মনে হতে পারে। কিন্তু এই চর্চা থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টা করতে হবে আমাদের। মাথায় রাখতে হবে যে এটা একটা ভালো উদ্যোগ।

সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ফ্যাশনের উপযোগিতা, নকশা এবং ফ্যাশন বিষয়ক অধ্যাপক কেট ফ্লেচার। তিনি বলেছেন, ‘কম পোশাক কেনা মোটেও দেহের প্রতি মারাত্মক কোন অবিচার বা বঞ্চনা নয়। কেনাকাটা করার সময় মানুষ অত্যন্ত তৃপ্তি লাভ করে। কিন্তু পরক্ষণেই ওই কেনা বস্তু বা পোশাকের ওপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ‘কেনাকাটা নিয়ে মানুষ কতটা সুখী এমন এক গবেষণায় দেখা যায়, মৌলিক চাহিদা মেটার পরে অন্যসব কেনা কাটা মানুষের কল্যাণে তেমন কোন কাজে আসে না’, যোগ করেন তিনি।

২. সেকেন্ড হ্যান্ড পোশাক কিনুন

টেকসই ফ্যাশন নিয়ে একাধিক বইয়ের লেখিকা ফ্লেচার বলেন, ‘জনপ্রিয় ফ্যাশনের শহরগুলো বা হাই স্ট্রিট কেনাকাটার জন্য খুব সুনির্দিষ্ট পরিসর দিয়ে থাকে যার মধ্য থেকেই মানুষ আগ্রহ নিয়ে কেনাকাটা করে। আপনার রুচি যদি আসলেই নতুনত্ব, আধুনিকতা, পরিবর্তন এবং বৈচিত্র্যের উপর নির্ভরশীল হয় তাহলে, আপনার ওয়্যারড্রোব আর সেকেন্ড হ্যান্ড পোশাক কেনাতেই আপনি এগুলো অনেক বেশি পরিমাণে খুঁজে পাবেন।’

ফ্রান্সেসকা উইলো, ইথিক্যাল ইউনিকর্ন নামে নিজের ফ্যাশন ব্লগের এই লেখিকা বলেন, ‘প্রথমেই খুঁজে দেখার জন্য সেকেন্ড হ্যান্ডই সবচেয়ে ভালো অপশন। কারণ এটি ইতোমধ্যে অস্তিত্ব রয়েছে এমন জিনিসের উপযোগিতা বাড়িয়ে দেয়।’

৩. প্রাকৃতিক উপাদান বাছাই করুন
টেকসই বিষয়ক ব্লগাররা বলেন, যেকোন মূল্যে নতুন সিনথেটিক উপাদান দিয়ে তৈরি পোশাক কেনা বন্ধ করতে হবে। উইলো বলেন, ‘আমি হেম্প, লিনেন এবং জৈব সুতি বস্ত্র যা গ্লোবাল অরগানিক টেক্সটাইল স্ট্যান্ডার্ডের অনুমোদনের আওতায় পড়ে এমন পোশাক নিখুঁত না হলেও কিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের উচিত কাপড়ের দীর্ঘস্থায়িত্ব বাড়ানো। এটা নির্ভর করে কিভাবে আপনি কাপড়ের যতœ নিচ্ছেন তার ওপর।’

৪. যাচাই করুন

উইলো বলেন, যেকোনো ব্র্যান্ড থেকে নতুন কাপড় কেনার আগে সেগুলো কোথায় এবং কারা বানিয়েছে সে বিষয়ে মানুষের প্রশ্ন করা উচিত। ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অনুমোদন পাওয়া ব্র্যান্ডগুলোর কাপড়ই কেনা উচিত। কারণ তারা অন্তত ন্যায্য মজুরির বিষয়টি নিশ্চিত করে। অনেক ব্লগ রয়েছে যেগুলোতে এ ধরণের ব্র্যান্ড সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে যা আপনার সহায়ক হতে পারে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।