বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। আকাশে দুটি মেঘখণ্ড বা দুটি বরফখণ্ড পরস্পর সংঘর্ষের ফলে বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়ে। কখনো কখনো এটি ভূ-মণ্ডলে নেমে আসে। সাধারণত এই ঘটনা বজ্রপাত নামে পরিচিত। এই বজ্রপাতের বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে মে মাসে। মেঘরাশিতে সৃষ্ট এই বিদ্যুৎ আকাশেই শেষ হয়। তবে কখনও কখনও মাটির ওপর আঘাত হেনে প্রাণহানিও ঘটায়। বজ্রপাতে প্রতিবছরই বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বজ্রপাত একটি সাধারণ ইস্যু হলেও এশিয়া মহাদেশে এর প্রভাব সবচেয়ে প্রকট। বজ্রপাতের কারণে বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বে বজ্রপাতে যতজন মারা যাচ্ছে, তার চার ভাগের এক ভাগই বাংলাদেশে। ভুটানকে বজ্রপাতের দেশ বলা হলেও এ দুর্যোগে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়।
বাংলাদেশের ২০১০ থেকে রাখা হিসাব বজ্রপাতে ক্রমান্বয়ে বেশি মানুষের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে। গত সাত বছরে এই হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ২০১৬ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩৫১ আর গত বছর মৃত্যু হয় ২৬২ জনের। এই হিসাব কেবল সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের পরিসংখ্যান। প্রকৃত অবস্থা হয়ত আরও ভয়াবহ।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১০ সালে ১২৪ জন, ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ৩০১ জন, ২০১৩ সালে ২৮৫ জন, ২০১৪ সালে ২১০ জন, ২০১৫ সালে ২৭৪ জন এবং ২০১৬ সালে প্রায় ৩৫০ জন বজ্রপাতে মারা গেছে। বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, ২০১৩ হতে ২০১৬ পর্যন্ত সংখ্যার যথাক্রমে ১২৮ জন, ৭৯ জন, ৯১ জন ও ১৩২ জন শুধুমাত্র এপ্রিল-মে মাসেই বজ্রাঘাতে মারা গেছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ৫-৬ মে ৩৩ জন, ২০১৫ সালের ২-৩মে ১৯ জন এবং ২০১৬ সালের ১১-১২মে ৫৭ জনের মৃত্যু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রধান পাঁচটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির একটা হিসাবে বলছে, দাবদাহ, সাইক্লোন, বন্যা আর ভূমিকম্পের চেয়ে বজ্রপাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। আলোচ্য ১০ বছরে সাইক্লোনে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেলেও বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে, বেড়েছে দাবদাহে মৃত্যুর হারও। তবে বজ্রপাতে মৃত্যুর হারের কাছে সেটা তেমন কিছু নয়। ২০০৪ সালে দাবদাহে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০০ জন, ২০১৩ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ২০০ জন। অন্যদিকে ২০০৪ সালে বজ্রপাতে মারা যায় প্রায় ১ হাজার ৮০০ জন। আর ২০১৩ সালে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২ হাজার ৮০০। (তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো, ইন্ডিয়া)
বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু এখনও এটি প্রতিরোধের কোনো উপায় বের করা সম্ভব হয়নি। বজ্রপাতের আগাম সংকেত দেয়ার কৌশল বিজ্ঞানীরা এখনও উদ্ভাবন করতে পারেননি। তাই এক রকম আতঙ্কের মধ্যেই রয়েছে দেশের মানুষ। তবে তাল গাছে মতো প্রচুর পরিমাণে উচু গাছ লাগানোর মাধ্যমে বজ্রপাত থেকে বাচা যায় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ সংক্রান্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যপঞ্জিতে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার প্রতি কোটিতে ৪ জনের কম। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে একমাত্র ভারত ছাড়া সব দেশে এই হার অনেক বেশি। পরিসংখ্যান মতে, বজ্রপাতে বছরে কোটি জনের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় মৃতের সংখ্যা ২৭ জন, নেপালে ২৪ জন। বাংলাদেশে এই হার প্রতি কোটিকে ৯ জন। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একে উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রধানত পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই এমন অস্বাভাবিক বজ্রপাত হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে। গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বজ্রপাতের ছয়টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হচ্ছে- ১. বাতাসের মাধ্যমে ঘন কালো মেঘ এবং মাটিতে থাকা নেগেটিভ ও পজেটিভ চার্জে পরিবাহী হওয়া ২.বনাঞ্চল উজাড় করা ৩. জলবায়ুর পরিবর্তন ৪. জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি ৫. অত্যধিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার এবং ৬. গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন বৃদ্ধি।
আবহাওয়াবিদ ও বজ্রপাত বিষয়ক বিজ্ঞানী ড. আব্দুল মান্নান বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই সাধারণত বজ্রপাত হয়। এ ছাড়া উপরের কারণগুলোর জন্য বজ্রপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি বছরের এপ্রিল ও মে মাসের তাপমাত্রা স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রার চেয়ে বেশি। এ কারণে বজ্রপাতের পরিমাণও এই সময় বেশি থাকে। বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী ‘সাইন্স’র এক প্রবন্ধে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বজ্রপাত বিষয়ক গবেষক ডেভিড রম্প বলেন, জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি, অত্যধিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার ও গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন বৃদ্ধির কারণে ভূ-মণ্ডলে নাইট্রোজেন অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে।
এই গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ওজোন স্তর এবং মিথেনের মতো ক্ষতিকর গ্যাসও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। তখন বজ্রপাতের হার কমতে পারে। এই শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনটি হলে বজ্রপাতের হার আরো বাড়তে পারে। রম্প বলেন, ২০০০ সালে যেখানে বছরের একটি নির্ধারিত সময়ে দুইবার বজ্রপাত রেকর্ড করা হয়েছে, সেখানে এখন ওই একই সময়ে তিনবার বজ্রপাত হচ্ছে। তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাতের হার বাড়ে ১২ শতাংশ। বাংলাদেশে বজ্রপাতের ঝুঁকি ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, আগে সাধারণত তালগাছ, নারিকেল গাছ ইত্যাদি গাছপালায় বজ্রপাতের ঘটনা বেশি লক্ষ্য করা যেত। কিন্তু এখন অনেক সময় সরাসরি মানুষের ওপরই আঘাত হানছে। বাংলাদেশে হাওর অঞ্চলকে এখন বজ্রপাতের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। গত কয়েক বছরে সুনামগঞ্চ, হবিগঞ্চ, সিলেট, কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাত বৃদ্ধি পায় সাড়ে ১২ শতাংশ। বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন, এই শতাব্দীর শেষে বজ্রপাতের পরিমাণ আরো ৫০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। বৃষ্টিপাতের তীব্রতা ও মেঘের পরিমাপের ভিত্তিতে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাই বজ্রপাত নিয়ে এখনই সতর্ক ও সচেতন হওয়ার সময়।
বজ্রপাতের হার বৃদ্ধি পেলে মানুষের হতাহত হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে।পাশাপাশি শুষ্ক বনাঞ্চলে দাবানলের আশঙ্কা আর্ও বাড়বে। সেক্ষেত্রে শুধু মানুষ নয় পশুপাখিসহ বিলুপ্তপ্রায় নানারকম প্রাণির প্রজাতি ধ্বংসের মুখে পড়বে। বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে ঝুঁকি ও শংকা সঙ্গত কারণেই বেশি। দেশে এমনিতেই বেশ কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, নদীভাঙন, ঝড়, ভূমিকম্প ইত্যাদি মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার ওপর প্রাক-বর্ষা মৌসুমে এ বজ্রপাত আতঙ্ক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।