।।রেজাউল ইসলাম।।আজকাল আমাদের দেশের বেশিরভাগ উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীর মধ্যে একটা সাধারণ মনোভাব তৈরি হয়েছে যে, পৃথিবীতে যত রকমের নীতি আছে রাজনীতি হল তাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ নীতি। রাজনীতি যেন তাদের কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছে দুচোখের বিষ।এর কারণ, রাজনীতি মানুষ খুন করে তাদের প্রাণের ক্যাম্পাসকে ত্রাসের রাজত্বে পরিণত করেছে। ছাত্রনেতাদের দৌরাত্ম্যে ক্যাম্পাসে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না। শুধু রাজনীতির কারণেই তারা তাদের ক্লাসরুমে, ক্যান্টিনে, খেলার মাঠে, টিভিরুমে, চায়ের দোকানে, এমনকি অধ্যয়ন কক্ষেও শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও নিগৃহীত হয়ে থাকে। সর্বত্র জেঁকে বসা অশুভ রাজনীতির করাল গ্রাসে তারা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক রুমে বসেও স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে না।
সমাজের সবখানে ক্যান্সারের মত বিস্তার লাভ করা এসব নেতিবাচক চিত্রই আমাদের বিদ্যানুরাগী ও শিক্ষিত তরুণ সমাজকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। আর রাজনীতি থেকে দূরে থাকার এ আধুনিক প্রবণতাকে তারা অধিকতর সম্মানজনক অবস্থান বলে দম্ভ পর্যন্ত করে থাকে। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় কিংবা টেলিভিশনে প্রচারিত সরাসরি কোনো অনুষ্ঠানে স্বপ্রতিভ ঢঙে অতি দর্প ও অহংবোধের সাথে বলে থাকে , রাজনীতির প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই; অথবা রাজনীতিকে তারা চরম মাত্রায় ঘৃণা করে। হালের যেসকল শিক্ষিত ও রুচিশীল তরুণ-তরুণী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে থাকে তাদের অধিকাংশেরই ফেসবুক প্রোফাইলে লেখা থাকে- hate politics অথবা Having no interest. অর্থাৎ তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে কিংবা রাজনীতিতে তাদের কোনো আগ্রহ নেই।
রাজনীতি বাদ দিয়ে তারা বরং হররোজ ক্রিকেট খেলা দেখা, টিএসসির সড়ক দ্বীপে জাতীয় পতাকা হাতে ব্যান্ড সঙ্গীতের তালে তালে নাচানাচি করা, সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়ে বুকে হাত রেখে পরম শ্রদ্ধায় দেশের জন্য ভালো কিছু করার শপথ করা, জাতীয় পতাকার রঙের টি-শার্ট পরে বন্ধু কিংবা বান্ধবীর হাত ধরে ক্যাম্পাসের সবুজ চত্বরে হেঁটে বেড়ান ইত্যাকার কাজকে অধিক দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করে থাকে। তাদের ধারণা, রাজনীতি তাদেরকে মারামারি ও হানাহানি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারছে না। অন্যদিকে, ক্রিকেট তাদের প্রিয় দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনছে, নাগরিকদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করছে, দেশের সবাইকে এক কাতারে শামিল করতে পারছে। অতএব, দেশকে ভালোবাসার জন্য আর আমাদের রাজনীতি করার প্রয়োজন নেই; এক ক্রিকেটই যথেষ্ট।
রাজনীতির প্রতি তরুণদের এহেন নেতিবাচক মনোভাব মূলত কোনো রকম ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ নয় বরং রাজনীতির প্রতি তাদের দীর্ঘদিনের প্রচ্ছন্ন অভিমানের বিষবৃক্ষ। এই যে রাজনীতি তাদেরকে খারাপ ছাড়া কখনও কোনো ভাল কিছু দিতে পারছে না। কিংবা কিছু হলেই দেশের সব রাস্তা-ঘাট অচল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা, অফিস আদালতে ধর্মঘট, রাজপথে রক্তের বন্যা বয়ে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। এসবের যোগফলে তারা ক্রমেই রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছে। স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর পরেও যখন রাজনীতি তাদের গণজীবনে শান্তি আনতে পারল না, মতপ্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারল না, হানাহানি, মারামারি বন্ধ করতে পারল না, তখন মিছে মিছে রাজনীতির পিছু ছুটে কি লাভ? এটাই হলো রাজনীতির প্রতি হালের তরুণ প্রজন্মের মূল ক্ষোভ ও চাপা অভিমান।
তাই যদি না হবে তাহলে কই আমাদের ষাট বা সত্তরের দশকের তরুণ প্রজন্ম তো এখনকার মতো রাজনীতি বিমুখ ছিল না? বুলেট, বোমা কিংবা প্রাণঘাতী ট্যাঙ্কের সামনে পড়েও তো বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন,ক্যাপ্টেন মনসুরের মতো মেধাবী ছাত্ররা রাজনীতির রক্তাক্ত মাঠ ছেড়ে আত্ম-প্রবঞ্চক উটপাখির মতো মরুভূমিতে মুখ লুকাননি? এসব গৌরবময় ইতিহাস থেকেই বোঝা যায় রাজনীতির প্রতি আমাদের তরুণদের ভালোবাসা ও হৃদ্যতার ঘাটতি কোনো কালেই ছিল না। ঘাটতি আজ যেটুকু হয়েছে তা ভালোবাসার নয়, জ্ঞানের।
রাজনীতি কী? এ প্রশ্নের উত্তর ষাটের দশকের পাকিস্তানী অক্টোপাসের যাঁতাকলে পিষ্ট ও নির্যাতিত শিক্ষিত ও রাজনীতি সচেতন বাঙালি তরুণ সমাজ যেমন ভালোভাবে জানতো, আজকের তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিকে তেমন করে জানে না। অপরাজনীতির শক্তি যে একটি জাতীর মুখের ভাষা কেড়ে নিতে পারে, তার শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল মুখ চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে পারে, স্বনামধন্য ও প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে তাকে মেধাশুণ্য করে পঙ্গু বানিয়ে ফেলতে পারে- এই মূল্যবান বোধ ও জ্ঞান লাভের সৌভাগ্য সে সময়ের শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের হয়েছিল।তাই তারা হালের তরুণদের মতো হতাশা ও অভিমানে রাজনীতি বিমুখ না হয়ে বরং সেই রাজনীতিরই হাল হ্যাঁচকা টানে পাকিস্তানি শোষকদের হাত থেকে কেড়ে নিতে বীরদর্পে রক্তসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিনিময়ে তারা শোষকদের হাত থেকে রাজনীতির ঝান্ডা কেড়ে নিয়ে বাঙালির ভাষা, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সুমহান গৌরবকে পুন: প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
সেদিনের সেই টগবগে মেধাবী তরুণেরা যদি হতাশা ও অভিমানের চাদরে মুখ ঢেকে রাজনীতিকে ভাগাড়ে ছুড়ে ফেলে দিত, তাহলে হয়তো আজ বাংলাদেশ নামের কোনো দেশের জন্ম হতো না, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে আবিষ্কার করা সম্ভব হতো না, কিংবা কে জানে আজ এই ষোল কোটি বাঙালির মুখে বাংলা ভাষা উচ্চারিত হতো কিনা! আজকের তরুণদের মধ্যে ইতিহাসের এই গৌরবময় জ্ঞানের অভাব দেখা দিয়েছে। কারণ তাদের তো কোনো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে দেশ স্বাধীন করতে হয়নি কিংবা পরাধীনতার নিগঢ় কী তা জানতে হয়নি। এজন্য তাদের মধ্যে রাজনীতির ব্যবহারিক বা বাস্তব জ্ঞানের জন্মলাভ ঘটেনি। রাজনীতি সম্পর্কে তারা যে সীমিত জ্ঞানটুকু রাখে তা শুধুই তাত্ত্বিক যা কখনো সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে না।
রাজনীতির এই ব্যবহারিক জ্ঞানের অভাবেই তারা মূলত জানে না আজ সারাদিন তারা যা করতে পেরেছে আর যা করতে পারেনি- তার সবই নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দ্বারা। এই যে তারা তাদের বাবা-মায়ের সাথে ফোনে কথা বলার সময় মিনিট প্রতি কত টাকা চার্জ পড়বে, যে শ্যাম্পু বা সাবানটা তারা গাঁয়ে মাখছে তার দাম কত হবে, যে ব্রান্ডের ঘড়ি বা জামা তারা ব্যবহার করছে তার দাম কত হবে, অধিকার সচেতন যে আধুনিকা মেয়েটি রস্তায় ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছে সে কিভাবে তার বিচার পাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে অবস্থানকারী তাদের কোন বোন কিংবা বান্ধবীকে দুর্বৃত্তরা তুলে নিয়ে গেছে তার বিচার কিভাবে নিশ্চিত হবে, গেস্ট রুম বা রাজনৈতিক কোন প্রোগ্রামে উপস্থিত না হওয়ার কারণে তাদের মেধাবী কোন ছোট ভাই যে ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক নিগ্রহের শিকার হয়েছে তার বিচার কিভাবে পাবে কিংবা তারা যে সমাজে একটি নির্দিষ্ট আদর্শ বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখে তার ভবিষ্যৎ কী হবে- এর সবই নির্ভর করে একটি চূড়ান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপরে।
এ ধরনের মারাত্মক রাজনৈতিক অজ্ঞতা বা মূর্খতা পর্যবেক্ষণ করে বিখ্যাত জার্মান নাট্যকার ও কবি বারটল্ড ব্রেখ্ট বলেছেন, The worst illiterate is the political illiterate, he doesn’t hear, doesn’t speak, nor participate in the political events. He doesn’t know the cost of life, the price of the bean, of the fish, of the flour, of the rent, of the shoes and of the medicine, all depends on political decisions.অর্থাৎ, একজন রাজনৈতিকভাবে মূর্খ ব্যক্তিই সব থেকে বড় মূর্খ।
বস্তুত, রাজনীতি হচ্ছে মানুষের সামাজিক অস্তিত্বের পূর্বশর্ত। রাজনীতি ছাড়া সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষ চলতে পারে না, কারণ রাজনীতির সাথে মানুষের সম্পর্ক প্রাকৃতিক ও অবিচ্ছেদ্য। এ জন্যই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল বলেছেন- Man is a political animal.অর্থাৎ, মানুষ একটি রাজনৈতিক প্রাণী। রাজনীতিই তার ধর্ম, রাজনীতিই তার নিঃশ্বাস -প্রশ্বাস। তাই রাজনীতিবিমুখতা নয় বরং তরুণ প্রজন্মের রাজনীতি সচেতনতাই পারে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে।
রেজাউল ইসলাম, শিক্ষক ও কলাম লেখক